আমার এবারের ভ্রমণ শেষ হলো। কলেজ শেষে অনেকটা হতাসা আর রাগ নিয়ে এ যাত্রা শুরু করেছিলাম, শেষ হতে লাগলো আট বছরের বেশি সময়। দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এত সময় যে কিভাবে গেলো বুঝতে পারলাম না। কি পেলাম এ দীর্ঘ যাত্রায়?
হ্যা। মাঝেমধ্যে খোঁজখবর নিবে, জানতে চাইবে কেমন আছি, সামান্য রাগে কিংবা অভিমানে ঝারি দিবে, এমন কয়েক বন্ধু পাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। খুব ভালো করছো, এগিয়ে যাও, শাবাস বলে অনুপ্রেরণা দেবার মতো কিছু অগ্রজ আমি পেয়েছি। ভাই আসছি, দেখা করবো, কই ভাই আপনি, বলার মতো অনুজ আমি পেয়েছি। আশেক, তোমার নাম মনে থাকবে, বড় হও- প্রত্যাশার শিক্ষক আমি পেয়েছি।
আপাত পক্ষ্যে আফসোসের কিছু নেই। আমরা যা পাই, তা আমাদের পাবার ছিলো, সে হোক অত্যাধিক আনন্দ কিংবা বুকফাটা দুঃখ। সমীকরণের যোগফল শুধু ধনাত্মক আসার ধ্যানধারণা থেকে বের হয়েছি অনেক আগেই। তাই কোন অভিযোগ নেই, আছে এক ঝুলি অভিজ্ঞতা, অনেক অনেক স্মৃতি- ভালোবাসার, আবেগের, উচ্ছাসের। আসলাম, ট্রেন ধরলাম, এটেন্ডেন্স দিলাম, বাসায় গেলাম, এমন বিশ্ববিদ্যালয় জীবন আমি পার করিনি। আমি কটেজে, হলে, এক নম্বর, সাউথ ক্যাম্পাস- নানান জায়গায় থেকেছি; কাটা পাহাড়ে বৃষ্টি বাদলের দিনে ব্যাঙ ধরতে বের হয়ে- সারা রাত কাটিয়েছি; আমি ক্যাম্পাসের ইঞ্চি ইঞ্চি জায়গা ঘুরেছি, দক্ষিণ পশ্চিম উত্তর পূর্ব- সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে বন্ধুদের সাথে গল্প করেছি; পাহাড়ে উঠেছি, হরিণের খোঁজে বেরিয়েছি; আরো কত কী! আমি ক্যাম্পাসের স্যাতস্যাতে গরমে না শুকোনো কাপড় নিয়ে বিরক্ত হয়েছি, শীতকালের অসহ্য ঠান্ডায় হাটতে বের হয়েছি, গলযোগের ঢুক গেলে ক্যাম্পাস ফিরেছি, শত অসত্য মেনে নিয়ে নিঃশব্দে হেটেছি।
বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে সম্পূর্ণ বিপরীত মতকে সমর্থন করানো শিখিয়েছে, যা অনেকের জীবদ্দশায় সম্ভব হয়ে উঠেনা। আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ছেলেকে দেখেছি, নাস্তিক- ঘোর স্রষ্টায় অবিশ্বাসীকে দেখেছি, আমি এ দুয়ের পরিবর্তনও দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি প্রণয় দেখেছি, মহাপ্রণয় দেখেছি, আমি বিচ্ছেদ দেখেছি, ঘোর বিরোধ দেখেছি; একজন আপাদমস্তক খারাপ মানুষের দুর্দান্ত ভালো গুণ এবং কারো প্রতি অশেষ অবলা ভালোবাসাও দেখেছি। আমি রাগ করা শিখেছি, মেকি রাগ করা শিখেছি, রাগ দমানো শিখেছি, রাগ না করে অনুসূচনা করা শিখেছি, আত্মসমর্থন করা শিখেছি, দিনে দিনে পরিবর্তন হয়েছি।
কেউ কি বলবে আমায়, এতটুকু কেউ দশ বছরেও শিখেছে? কেউ তো মেনে নেয়া শিখতেও পারেনা এ জীবনে! আমি যে কোন দৌড়ে নেই, যে দৌড় সব হতাশার মূলে, তা-ই বা ক’জন শিখে?
বসন্তের ফুল, শুকনো পাতা কুড়োনো, চাঁদের দিকে অপলক চেয়ে থাকা, বর্ষাকালে পদ্মফুলের পুকুরের পাশে নিরব বসে সন্ধ্যা পার, আচমকা ঘুম ভেঙে বিকেলের খেলার শব্দ, টিকটিকির ছায়া, আমার অগুনতি স্মৃতি- আমি দ্বায়বদ্ধ, আমি কৃতজ্ঞ। আমার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বিপরীতে বলা আগুন শব্দ- তাও তো এখানে শেখা!
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, শেষ হলো জানুয়ারীর বারো তারিখ! আমার দীর্ঘ ভ্রমণের নৌকা এবার অন্য দিগন্তে ভিড়বে!